Monday, June 6, 2011

 অন্তিম শয়নে আজম খান

পপসম্রাট খ্যাত সংগীতশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা আজম খানের মরদেহের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। আজ দুপুরে বায়তুল মোকাররম মসজিদে জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে। সেখানেই তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।
মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে আজম খানের জন্য বরাদ্দ করা কবরের জায়গা নিয়ে কিছুটা জটিলতা থাকায়, দাফনকাজ শুরু হতে কিছুটা দেরি হয়। জটিলতার অবসান হলে বিকেল চারটা ৩৫ মিনিটে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় চিরনিদ্রায় শায়িত হন মুক্তিযোদ্ধা আজম খান।

এদিকে, আজ সোমবার সকাল ১০টার দিকে আজম খানের মরদেহ শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। আজম খানের কফিনটি জাতীয় পতাকায় ঢাকা ছিল। শহীদ মিনারে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা, সরকারি ও বিরোধী দলের নেতা-নেত্রী ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, সংস্কৃতিসেবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষ ফুল দিয়ে নানাভাবে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। এ সময় আজম খানের কফিন সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়।
শহীদ মিনারে আজম খানের মরদেহ নেওয়ার পর বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল গার্ড অব অনার প্রদান করে।
এর আগে আজম খানের মরদেহ আজ সকাল সাড়ে ছয়টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে কমলাপুরের জসীমউদ্দীন রোডে তাঁর নিজ বাড়িতে নেওয়া হয়। সেখানে পরিবারের লোকজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বেশ কিছুক্ষণ রাখা হয় আজম খানের মরদেহ। সকাল নয়টায় বাড়ির সামনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে আজম খানকে রাষ্ট্রীয়ভাবেও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন রোগভোগের পর গতকাল রোববার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) আজম খান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
গুরু হয়েও সাধারণ: বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনে শিল্পী আজম খান ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল। খোলা মনের মানুষ। অনেকটা নিভৃতে, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন তিনি। ‘আলাল দুলাল’, ‘সালেকা মালেকা’, ‘রেল লাইনের বস্তির ছেলে’র কথা তুলে ধরে তিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা গানে সমাজের নিচুতলার অতি সাধারণ মানুষকে উপস্থাপন করেছিলেন। এসব সাধারণ মানুষ, তাঁর ব্যতিক্রমী কণ্ঠস্বর এবং সংগীত পরিবেশনার একান্ত আপন আঙ্গিক তাঁকে দ্রুত জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়। বিশেষ করে, ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে জন্মে ছিল একটি ছেলে/ ছেলেটি মরে গেছে/ মা তার কাঁদে/ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি শ্রোতাদের হূদয়ে তাঁর স্থায়ী আসন তৈরি করে দেয়।
আজম খানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার আজিমপুরের সরকারি কোয়ার্টারে। পুরো নাম মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। বাবা আফতাব উদ্দিন খান সরকারি চাকরিজীবী। মা জোবেদা বেগম সংগীতশিল্পী। শৈশব থেকেই সংগীতে অনুরাগ। মায়ের অনুপ্রেরণায় নিয়মিত চর্চা। ১৯৬৬ সালে তিনি সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৮ সালে টিঅ্যান্ডটি মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করেন।
দেশে তখন আইয়ুব খানবিরোধী উত্তাল আন্দোলন। সক্রিয়ভাবে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। জনতার আন্দোলনকে বেগবান করতে ‘ক্রান্তি শিল্পীগোষ্ঠী’র সদস্য তরুণ আজম খান গণসংগীত গেয়ে পথে নামেন। তারপর শুরু হলো বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম। তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়া মাত্র চলে যান আগরতলায়। একদিকে নিয়েছেন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, অন্যদিকে প্রশিক্ষণ শিবিরে গান গেয়ে অনুপ্রাণিত করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র হাতে অংশ নিয়েছেন সম্মুখ সমরে। দেশমাতৃকার পরাজয়ের শৃঙ্খল মুক্ত করে বীরের বেশে ফিরেছেন প্রিয় ঢাকায়।
প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সেই যে ছেদ পড়েছিল, তা আর এগোয়নি। সংগীতে যে অনন্য প্রতিভা ছিল তাঁর, সেটিকেই সাধনার পথ ও জীবিকার উপায় হিসেবে আঁঁকড়ে ছিলেন আমৃত্যু। পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্র রীতিতে বাংলা গানে নতুন মাত্র এনেছিলেন তিনি। শ্রোতাদের কাছে তখন এ ধরনের গান ছিল একেবারেই নতুন। এই নতুন ধারার গানের পথিকৃত্ হিসেবে তিনি শ্রোতাদের কাছে ‘পপসম্রাট’ বা ‘পপগুরু’ হিসেবে সম্মানিত হন।
১৯৭২ সলে ‘উচ্চারণ’ নামের ব্যান্ড দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিল। সে বছরই বিটিভিতে প্রচারিত ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ ও ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ এই গান দুটি তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। এরপর ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘রেললাইনের ঐ বস্তিতে’, ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না’, ‘আলাল ও দুলাল’, ‘হারিয়ে গেছে খুঁজে পাব না’—এসব গানে গানে তিনি শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন। এক যুগ নামে তাঁর প্রথম অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। সব মিলিয়ে তাঁর গানের অ্যালবাম ১৭টি। জনপ্রিয় অন্যান্য গানের মধ্যে আছে, ‘এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছু রবে না রে’, ‘হাইকোর্টের মাজারে, ‘জীবনে কিছু পাব না’, ‘পাপড়ি কেন বোঝে না’, ‘সাঁইজি’, ‘সব মানুষই সাদা কালো’, ‘মানুষ নামে খেলনা’, ‘জীবনের শেষ কটা দিন’, ‘অনামিকা’, ‘অভিমানী’ এসব।
২০০৩ সালে গডফাদার নামের একটি বাংলা চলচ্চিত্রেও আজম খান অভিনয় করেন। কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হয়েছেন। সংগীতের পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। সাঁতারের প্রশিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৮১ সালে তিনি সাহেদা বেগমকে বিয়ে করেন। তাঁর দুই মেয়ে ইমা খান ও অরণী খান এবং ছেলে হূদয় খান। আজম খানরা চার ভাই ও দুই বোন। বরেণ্য সুরকার আলম খান তাঁর বড় ভাই।
পুরস্কার ও সম্মাননা: বর্ণাঢ্য জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন আজম খান। এর মধ্যে হলিউড থেকে ডিস্কো রেকর্ডিংয়ের সৌজন্যে ১৯৯৩ সালে বেস্ট পপ সিঙ্গার অ্যাওয়ার্ড, টেলিভিশন দর্শক পুরস্কার ২০০২, কোকাকোলা গোল্ড বোটলসহ লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, কাউন্সিল অব আরবান গেরিলা ঢাকা ’৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা এবং রেডিও টুডের পক্ষ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা উল্লেখযোগ্য।

No comments:

Post a Comment